ভূমিকা: দেশে যে কয়টি দানাশস্য উৎপাদন হয় তার মধ্যে ধান হচ্ছে প্রধান খাদ্যশস্য। পৃথিবীর মধ্যে এটি দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। সারা বিশ্বে ধান উৎপাদনকারী প্রধান দেশগুলো হচ্ছে- চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, ভূটান, কেনিয়া, ফিলিপাইন, মায়ানমার, নেপাল, জাপান, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে ৩ কোটি ৩৮ লক্ষ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয় (BBS ২০১৭)।
ধান একটি তন্দুল বা দানা জাতীয় ফসলের পরিপক্ক ডিম্বাশয়। এটি বীজ নয় বরং একে ক্যরিঅপসিস জাতীয় ফল বলে। এটি গ্রামীনি বা পোয়েসি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এ জাতীয় গাছের ফলে একটি বীজ থাকে বলে একে বীজ হিসেবেই ধরা হয়।
চাল : ধানের খোসা ছাড়ানোর পর যে অংশ পাওয়া যায় তাকে চাউল বা চাল বলে। ধানের তিন ভাগের এক ভাগ খোলা ও বাকি দুই ভাগ চাল। চালে ৭৯% শর্করা, ৬.৪% আমিষ ও ০.৪% স্নেহ জাতীয় পদার্থ থাকে ।
ধানের বৈশিষ্ট্য : ধানের বৈজ্ঞানিক নাম অরাইজা স্যাটাইভা (Oryza Sativa)। এর কাণ্ড নরম, এর পাতা ফলক ও খোল দুইটি অংশে বিভক্ত। গত্র ফলকের গোড়ায় অরিকল থাকে, শিকড় গুচ্ছমূল এটা একবীজপত্রী ও সমান (Albuminious)। এর তিনটি উপজাত রয়েছে। যেমন-
(ক) ইন্ডিকা : এ ধান গ্রীষ্মপ্রধান দেশে যেমন- বাংলাদেশ, ভারত পাকিস্তান, নেপাল ও ভূটান জন্মে। ভাত ঝরঝরে হয়।
(খ) জাপানিকা: এ খানের গাছ খাটো ভাত আঠালো হয়। তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া ও জাপানে এ ধান জন্মে।
(গ) জাভানিকা: এ খানের হুঁশি কম তাই ফলন কম, ইন্দোনেশিয়াতে জন্মে। মৌসুম ভেদে আমাদের দেশে তিন ধরনের ধান জন্মে হয়ে থাক। যেমন-
(ক) আউশ ধান : এ ধান আবাদের সময় ১৫ই মার্চ থেকে ১৫ই মে (চৈত্র-বৈশাখ) এবং ধান কাটার সময় ১৫ই জুন থেকে ১৫ই আগস্ট (আষাঢ়- শ্রাবণ) এ ধান আবাদে কম সময় লাগে।
(খ) আমন ধান : এ ধানের চারা রোপণের সময় ১৫ই জুন থেকে ১৫ই আগস্ট (আষাঢ়-ভাদ্র) এবং ধান কাটার সময় ১৫ই অক্টোবর-১৫ই জানুয়ারি (কার্তিক-পৌষ)। ধান আবাদে বেশি সময় লাগে ।
(গ) বোরো ধান : এ ধানের বপনের সময় ১৫ই ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি (পৌষ-মাঘ) এবং ধান কাটার সময় ১৫ই মার্চ থেকে ১৫ই মে (চৈত্র-বৈশাখ)। এটি আবাদে মাধ্যম সময় লাগে ।
১৯৭০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক (ব্রি) উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল (উফশী) ধানের জাত, মৌসুম, গড় উচ্চতা, গড় জীবনকাল, জাতের বৈশিষ্ট্য, গড় ফলন ও অবমুক্তের বছর নিম্নের ছকে দেয়া হলো ।
১ জীবনকাল বপনের সময়ের ওপর নির্ভর করে কম-বেশি হয়।
* বৃষ্টিবহুল এলাকার উপযোগী ।
** আলোক-সংবেদনশীল।
*** ব্রি ধান ৪২ এবং ব্রি ধান ৪৩ বৃষ্টিবহুল এবং খরা প্রবণ উভয় অঞ্চলের উপযোগী ।
সূত্র:- কৃষি ডায়েরি- ২০১৬ ইং
ধানের বিভিন্ন অংশ নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
১) তুষ (Husk) : এটি ধানের বহিরাবরণ। ধানের দুইটি বন্ধ্যা গুম, লেমা ও প্যালিয়া একত্রে মিলে তুষ তৈরি হয়। ধানের বহিরাবরণ বা খোসা ছেটে তুষ বের করে নিলে লাল আবরণসহ চালের দানা পাওয়া যায়। তুষ মানুষের ভক্ষণযোগ্য নয় ।
২) কুঁড়া (Bran) : চালের বহিরাবরণকে কুঁড়া বলে। ধানের তুষ বের করে নেওয়ার পর চাল বা দানার উপরের লাল ও খুবই পাতলা আবরণ ছাঁটাই করলে তা কুঁড়া হয়ে বেরিয়ে আসে। এই আবরণ সেলুলোজ দিয়ে তৈরি। এই আবরণসহ চাল খেলে সেলুলোজের জন্য শরীরে খাদ্য থেকে পুষ্টি শোষণে বাধা ঘটে। সেজন্য কুঁড়া ছেটে বাদ দেওয়া হয়।
(৩) অ্যালুরেন স্তর : তুষ ও কুঁড়া বের করে নেওয়ার পরও চালের উপর হালকা বাদামি রঙের গুঁড়ার মতো যে স্তরটি থাকে তাকে অ্যালুরেন স্তর বলে। এই স্তরের জন্য চাল আকাড়া থাকে। আকাড়া চাল সহজে শোষিত হয় না। অ্যালুরেন স্তরে প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ থাকে। ঢেঁকিতে চাল ভাঙ্গালে চালের উপর এই স্তর থেকে যায়। কিন্তু মেশিনে ধান ছাঁটাই করলে অ্যালুরেন স্তর আলাদা হয়ে চাল সাদা ও মসৃণ হয় । অ্যালুরেন স্তর আলাদা হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে চালের ভিটামিন ও প্রোটিন কমে যায়।
(৪) শস্য (Endosperm) : ধানের মূল দানাই হচ্ছে শস্য বা এন্ডোসপার্ম। এটি ধানের ৭৫ ভাগ অংশ । চালের দানার প্রায় সম্পূর্ণ অংশ হচ্ছে ৭৭-৭৯% শ্বেতসার। এন্ডোসপার্মের প্রান্তদেশে আয়োডিন, প্রোটিন এবং সামান্য লৌহ থাকে ।
(৫) ভ্রূণ (Embryo) : চালের দানার নিম্ন প্রান্তে অর্থাৎ বোঁটার দিকের প্রান্তে অবস্থিত ভ্রূণ খাদ্য উপাদানে সমৃদ্ধ। ভ্রূণে ভিটামিন-ই, রিবোফ্লোভিন, থায়ামিন, নায়াসিন, লৌহ এবং স্নেহ পদার্থ থাকে ।
চালের পুষ্টিমান : চালের পুষ্টি উপাদানের মধ্যে বেশিরভাগই শ্বেতসার যা চালের ভিতরের দিকে বা সস্যল অংশে থাকে। কিন্তু চর্বি, আঁশ এবং খনিজ লবণ থাকে দানার বাহিরের দিকে। চালে আমিষের ভাগ গম বা ভুট্টা থেকে কম থাকে। কলে ছাঁটা ও ঢেঁকি ছাঁটা চালের পুষ্টিমান নিম্নে দেওয়া হলো—
সারণি : চালের পুষ্টিমান (শতকরা হারে)
চালে আমিষের পরিমাণ শতকরা গড়ে ৭.৫ ভাগ এবং চালের আমিষের জৈবিক মান কম-বেশি ৬৮ ভাগ । অর্থাৎ চালে যে আমিষ থাকে দেহ তার ৬৮ ভাগ কাজে লাগাতে পারে। চালে ১৭টি অ্যামাইনো এসিড থাকে। এর মধ্যে অত্যাবশ্যক অ্যামাইনো এসিড-গুলো হলো- আইসোলিউসিন, লিউসিন, লাইসিন, ফিনাইল- এলানিন, মেথিওনিন, থায়ামিন, ট্রিপ্টোফেন, ও ভ্যালিন। শর্করা ও আমিষ ছাড়াও চাল ‘বি’ পরিবারের কয়েকটি ভিটামিন যথা- ‘বি১' (থায়ামিন), বি২ (রিবোফ্লোভিন), নায়াসিন ও ফলিক এসিড এবং লৌহের ভালো উৎস। ধানের বিভিন্ন অংশে উক্ত চারটি ভিটামিন ও লৌহের পরিমাণ দেখানো হলো-
ধানের পুষ্টি অপচয় : যে প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশে ধান কলে ছেটে চাল তৈরি ও চাল থেকে ভাত, রান্না করা হয় তাতে বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজের প্রায় সবটুকুই নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য আমাদের দেশের লোকজন পুষ্টিহীনতায় ভোগে। ঢেঁকিতে ছাঁটা চাল পুষ্টির দিক দিয়ে উন্নত কিন্তু শ্রমসাধ্য বিধায় কৃষকেরা ধান ঢেঁকিতে না ভেঙে কলে ভাঙাতে ইচ্ছুক। কলে ও ঢেঁকিতে ভাঙানো সিদ্ধ ও আতপ চালে প্রাপ্য তিনটি ভিটামিন ও লৌহের পরিমাণ নিচের সারণীতে দেখানো হলো ।
সারণি : আতপ ও সিদ্ধ ধান থেকে কলে ও ঢেঁকিতে ভাঙানো চালে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান (মিলিগ্রাম ১০০ গ্রামে)
ভাত বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক লোকের প্রধান খাদ্য চাল। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, জাপান, বার্মা, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে প্রচুর ধান উৎপাদন হয়। বাংলাদেশের মানুষ ৫ : ১ অনুপাতে ভাতের সাথে শাকসবজি খায়। আমাদের দেশের মানুষ তার দেহের প্রয়োজনীয় তাপশক্তির শতকরা ৭৫-৮৩ ভাগ পায় শ্বেতসার জাতীয় খাদ্য থেকে। শ্বেতসার জাতীয় খাদ্যের মধ্যে ৮০ ভাগই হল ধান বা চাল। ধান বা চাল থেকে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য ও শৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করা যায়। যেমন-
(ক) মানুষের খাদ্যদ্রব্য
১) ভাত
২) চিড়া
৩) খৈ, খৈ এর মোয়া ও মুড়কি
৪) মোয়া ও মুড়কি
৫) নাডু
৬) জাউ ভাত
৭) পোলাও ও বিরিয়ানি
৮) খিচুড়ি
৯) মুড়ি, মিষ্টিমুড়ি ও ঝালমুড়ি।
১০) ফ্রায়েড রাইস
১১) পায়েস ও ক্ষীর
১২) স্যুপ ও মাড় বা ফেন
১৩) চালের আটা বা গুঁড়ি (রুটি তৈরি ও বিভিন্ন পিঠা ও তৈরির জন্য)
১৪) চালের গুঁড়ি থেকে বড়া, নিমকি ও পাপড়
১৫) ভাতের মাদক
১৬) বেগুনি তৈরিতে চালের আটা
১৭) চিপস তৈরি
১৮) চাল ভেজে ছাতু
১৯) বেকারিতে বিভিন্ন খাদ্যে চালের গুঁড়ি ব্যবহার
২০) ওরসালাইন তৈরিতে
২১) ভাতের পাপড় ইত্যাদি
(খ) পশুপাখির খাদ্য :
১) ধানের কুঁড়া
২) ভাঙা চাল
৩) ধানের খড়
ধান ফসল আবাদের পর কর্তন, সংগ্রহ ও গুদামজাত করা হয়। এ ধান ও চাল অনেকদিন ধরে অর্থাৎ পরবর্তী মৌসুম পর্যন্ত খাওয়া হয়। কোনো কোনো সময় বিশেষ জাতীয় প্রয়োজনে ধান সংরক্ষণ করা হয়। যেমন- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, খরা ইত্যাদি সময় যাতে খাদ্যাভাব দেখা না যায়।
ধান কর্তনের পরের দিন থেকে এর গুণাগুণ ও পরিমাণ কমতে থাকে। গুদামজাত করার পর থেকে গুদামে দানার ক্ষতি ২-৬ ভাগ পর্যন্ত থেকে পারে। ধান সংরক্ষণের প্রধান উদ্দেশ্য হলো গুদামজাত অবস্থায় ফসলের গুণাগুণ ও পরিমাণ সঠিকভাবে বজায় রাখা। এছাড়াও অমৌসুমে ধান পাওয়া যায় এবং এর অপচয় কম হয়। গুদামে ধান তিন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত থেকে পারে। যেমন-
ক) যান্ত্রিক কারণ
খ) জৈবিক কারণ
গ) জৈব-রাসায়নিক কারণ
যান্ত্রিক কারণ : ধান কর্তনের ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নাড়াচাড়ার ফলে ধানবীজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধান বীজে আর্দ্রতার পরিবর্তন হলে বীজ সংকুচিত হয়ে যায়। এজন্য গুদামঘরের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সুষ্ঠুভাবে ধান সংরক্ষণের জন্য বীজে ১২-১৪ ভাগ আর্দ্রতায় আনা হয় ।
জৈবিক কারণ : বিভিন্ন অনুজীব বিশেষ করে ছত্রাক এবং গুদামজাত ক্ষতিকর পোকামাকড় বীজের গুণাগুণ নষ্ট করে। এজন্য গুদামের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। অধিকাংশ অনুজীবের ও পোকার বৃদ্ধির জন্য ৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা জরুরি। গুদামের সবচেয়ে ক্ষতিকরক পোকা হচ্ছে বিটল ও মথ। এছাড়া ইঁদুর ও পাখি অনেক সময় গুদামে ঢুকে সংরক্ষিত ধানের ক্ষতি করে।
জৈব রাসায়নিক কারণ : ধানবীজ একটি জীবন্ত শস্যদানা। গুদামের মধ্যেও এর ভ্রূণের শ্বসন ক্রিয়া চলতে থাকে। ফলে জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে তাপ ও জলীয় বাষ্প উৎপন্ন হয়। তাই ধানবীজ নিরাপদ সংরক্ষণের জন্য এই জলীয় বাষ্প ও তাপ বের করা খুবই প্রয়োজন।
গুদামঘরের প্রকারভেদ : বিভিন্নভাবে ধানবীজ গুদামে সংরক্ষণ করা যায়। এগুলো নিম্নরূপ-
ক) খামারবাড়িতে সংরক্ষণ : খাবার চাহিদা মেটানোর জন্য ধানবীজ বা শস্যদানা খামারের ভিতরেই গুদামে সংরক্ষণ করা হয়। এজন্য যে পাত্র ব্যবহার করা হয় তা হল-চটের বস্তা, কাঠের বাক্স, বাঁশের ঝুড়ি বা ডোল ও ড্রাম।
খ) ফসলের গোলা : দীর্ঘসময় ধরে ধান গুদামজাত করার জন্য ছোট আকারের কাঠামো তৈরি করা হয়। যেমন- কাঠ, বাঁশ, ধাতব শিট বা সিমেন্টের ঢালাই ইত্যাদি দ্বারা নির্মিত গোলা ।
গ) পাকা গুদাম : এ ক্ষেত্রে সাধারণত চালের মিলে এবং সরকারি সংস্থায় পাকা গুদাম ব্যবহার করে গুদামজাত করা হয়। ধানবীজকে বস্তায় ভরে গুদামে সারি করে স্তরে স্তরে সাজানো হয়। গুদামে ধানবীজের বস্তা ভিন্ন সারিতে সাজানো যেতে পারে। ফসলের দানা শস্যের বস্তা সাজানোর পদ্ধতি চিত্রে দেখানো হলো। এ ধরনের গুদামের মেঝে দেয়াল ও ছাদ পাকা করা হয় এবং আর্দ্রতা প্রতিরোধক করা হয়।
ঘ) ঢালাও গুদাম : শস্যদানা গুদামঘরের মেঝেতে স্তূপাকারে রাখা হয়, তবে আলো বাতাস চলাচলের যথাযথ ব্যবস্থা রাখতে হয়। এখানে কোনো বস্তা বা ব্যাগ ব্যবহার করা হয় না।
ঙ) সাইলো : খাদ্য মন্ত্রণালয় দীর্ঘ সময় ধরে ধান বা চাল সংরক্ষণের জন্য যে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত গুদাম তৈরি করে তাকে সাইলো বলে ।
খাদ্যশস্য গুদামে ভালোভাবে সংরক্ষণ করা একটি বড় সমস্যা। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (FAO) এর মতে পৃথিবীতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন শস্য গুদামে নাড়াচূড়ার দরুন নষ্ট হয়। কোনো কোনো দেশে শতকরা ১৫-৩০ ভাগ শস্য গুদামে নষ্ট হয়। উল্লেখ্য যে ৫০ ধরনের পোকা আমাদের দেশে গোলাজাত শস্যের ক্ষতিসাধন করে থাকে। পরিবেশগত দিক থেকে পোকামাকড়ের অবস্থা ও বংশ বিস্তারের জন্য বাংলাদেশ মোটামুটিভাবে উত্তম স্থান। এখানে অনুকূল আবহাওয়ার দরুন পোকামাকড় দ্রুত বংশবিস্তার করে। ফলে গুদামজাত শস্য অতি অল্প সময়ের মধ্যে পোকাক্রান্ত হয়। নিম্নে গুদামজাত ধান ফসলের প্রধান প্রধান পোকার পরিচিতি ও ক্ষতির প্রকৃতি বর্ণনা করা হলো-
১. ধানের শুঁড় পোকা : গুদামজাত শস্যেরে কীটপতঙ্গের মধ্যে এটি অন্যতম। ইংরেজিতে এদের রাইস উইভিল বলে। এদের প্রধান খাদ্য ধান। এছাড়াও এরা গম, ভুট্টা প্রভৃতি আক্রমণ করে। এদের মাথার সামনে একটি শক্ত ও লম্বা শুঁড় থাকে। এরা শস্যের মধ্যে গর্ত করে শস্যের শাঁস খেয়ে থাকে। বাংলাদেশে এই পোকা বর্ষাকালে, বিশেষ করে আষাঢ় মাস থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত বেশি ক্ষতি করে।
২. কেড়ি পোকা : ইংরেজিতে একে লেসার গ্রেইন বোরার বলে। এ পোকা ধান ও গম ফসলের বেশি ক্ষতি করে এদের চোয়াল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এর সাহায্যে এরা শস্যদানার ভেতরের অংশ কুরে কুরে খায়। খাওয়ার ফলে শস্যদানার ভেতরের অংশ ফাঁপা হয়ে যায় এবং শুধু বাইরের খোসাটি অবশিষ্ট থাকে। একবার শস্যদানার মধ্যে ঢুকলে জীবনের অবশিষ্ট সময় এখানেই কাটিয়ে দেয় ।
৩. লাল শূসরী পোকা : ইংরেজিতে একে গ্রেইন বিটল বলে। এদের শরীরে লাল ও বাদামি রঙের হয়ে থাকে। পূর্ণবয়স্ক পোকা ও কীড়া উভয়ে গুদামজাত শস্যদানা বা প্রস্তুতকৃত খাদ্যদ্রব্য আক্রমণ করে। সাধারণত এরা অক্ষত ও পূর্ণ দানা আক্রমণ করে না। অন্য পোকা খাওয়া দানায় এরা ক্ষতি করে । পোকায় আক্রান্ত ময়দা, সুজি ও আটা একসাথে দলা বেঁধে যায় এবং খাওয়ার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।
৪. খাগড়া বিটল: দামজাত শস্যের জন্য এটি একটি মারাত্মক পোকা। এ পোকা না খেরে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে। এ পোকা ধান, গম, ভুট্টা, আটা ও ময়দায় আক্রমণ করে। পোকার কীড়া দানার ক্ষতি করে। এরা গুদামজাত শস্যের উপরের স্তরে আক্রমণ শুরু করে এবং কখনও খুব বেশি ভিতরে ঢোকে না।
৫. ধানের সুরুই পোকা : ইংরেজিতে একে রাইস মথ বলে। এ পোকা ধান, পম ভুট্টা ও অন্যান্য শস্যদানা আক্রমণ করে। এ পোকার কীড়া খানের খোসা ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে ভেতরের শাঁস খেয়ে থাকে। আক্রান্ত খানের মধ্যে এরা গোলাকার ছিদ্র করে খার। সাধারণত এরা ধানের উপরের স্তরে বেশি ক্ষতি করে।
৬. চালের সুরুই পোকা : একে রাইস মিল মথ বলে। এরা ধানের সুরুই পোকা থেকে একটু বড়। এ পোকা চালের সবচেরে বেশি ক্ষতি করে। কীড়াগুলো এক প্রকার রেশমি জান তৈরি করে তার নিচে থেকে চালের ক্ষতি করে। আক্রান্ত শস্যদানা দুর্গন্ধ যুক্ত এবং খাওয়া বা বিক্রির অনুপযুক্ত হয়ে যায় এবং বড় বড় জটা সৃষ্টি করে।
৭. সুরুই পোকা : একে ইন্ডিয়ান মিল মথ বলে। এ পোকা বিভিন্ন প্রকার শস্যদানা, খাদ্য বন্ধ, সয়াবিন, শুকনো ফল, বাদাম ইত্যাদি আক্রমণ করে। শস্য দানার উপর এরা রেশমি সুতা দিয়ে একটি জাল তৈরি করে যার সাথে পোকার বিষ্ঠা মিশানো থাকে।
গুদাম শস্যের পোকামাকড় দমনের জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাকে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি। যেমন- ক) প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, খ) প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা :
১. শস্য কাটার পরবর্তী সময়ে শস্যদানাকে বেশি সময় ধরে মাঠে ফেলে রাখা যাবে না।
২. রোদে শুকানোর সময় আশে পাশের গুদাম থেকে পোকা এসে যাতে আক্রমণ করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে ভালোভাবে শস্যদানা শুকাতে হবে।
৩. শস্যদানাকে ভালোভাবে বাছাই করে গোলাজাত করতে হবে।
৪. গুদাম ঘরে যথেষ্ট আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৫. গোলাজাত করার পাত্রগুলোকে উত্তমরূপে শুকিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
৬. সংররক্ষণ পাত্র এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে এদের মুখ খুব ছোট এবং পেট অপেক্ষাকৃত মোটা হয় ।
৭. শস্য ভর্তি করার পর মুখে কিছু বালি, তুষ বা কুঁড়া বা নিম পাতার গুঁড়া দিতে হবে। তারপর মুখ কাঁদা দিয়ে বন্ধ করতে হবে যাতে কোনো ছিদ্র না থাকে ।
৮. শস্য গোলজাত করার সময় বাঁশের নির্মিত গোলা বা ডোলের ভেতর ও বাহিরের অংশ গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে ভালোভাবে প্রলেপ দিতে হয়।
৯. প্রতি কেজি শস্য দানার সাথে ২.৯ গ্রাম হারে নিম. নিশিন্দা বা বিষকাটালী পাতার গুঁড়ো মিশিয়ে সংরক্ষণ করলে পোকার আক্রমণ কম হয় ।
প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা :
১. বাহির থেকে গুদাম ঘরের ভেতরে ঠাণ্ডা বাতাস প্রয়োগ করে পোকামাকড় দমন করা যায় ।
২. গামা রশ্মি প্রয়োগ করে বিকিরণের মাধ্যমে পোকামাকড় দমন করা যায় ।
৩. প্রতি ১০০০ ঘনফুট জায়গায় ফলিথিয়ন (৫০ ইসি) অথবা ডিডিভিপি (১০০) ইত্যাদির ৮৫ গ্রাম কীটনাশক ৪.৫ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায় ।
৪. গুদামজাত প্রতিটন বীজে ২-৪ টি ফসটকসিন ট্যাবলেট ব্যবহার করা হলে কীটপ্রতঙ্গ মারা যায়।
ধান থেকে উৎপাদিত চাল আমাদের দেশে দুইভাবে ব্যবহার হয়। যথা-
(ক) আতপ চাল : সংগৃহীত ধানকে শুকিয়ে সরাসরি মিলিং করে যে চাল পাওয়া যায় তাকে আতপ চাল বা সান ড্রাইড রাইস (Sundried Rice) বলে।
(খ) সিদ্ধচাল : সংগৃহীত ধানকে সিদ্ধ করা হয়। তারপর শুকিয়ে মিলিং করে যে চাল পাওয়া যায় তাকে সিদ্ধ বা পারবয়েলড রাইস (Parboild rice) বলে।
ধান সিদ্ধ করা একটি প্রাচীন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। ধান সিদ্ধ করা প্রথমে শুরু হয়েছিল ভারতে এবং এই উপমহাদশে এখনও ব্যাপকভাবে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সিদ্ধ চাল ব্যবহার করা হয়। যেমন- বাংলাদেশ, নেপাল, বার্মা, শ্রীলংকা, মালেশিয়া এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশে। ধারণা করা হয় এই উপমহাদেশে প্রায় অর্ধেক সিদ্ধ চাল খাওয়া হয় যা পৃথিবীর মোট চালের এক-পঞ্চমাংশ। তবে সুগন্ধি চাল সিদ্ধ করা হয় না কারণ তাতে চালের সুগন্ধ অনকেটা চলে যায়।
ধান সিদ্ধকরণের সুবিধা ও অসুবিধা :
সুবিধা :
(১) সিদ্ধ করার ফলে ধানের খোসা ফেটে যায়। ফলে চাল থেকে তুষ বা খোসা সহজে পৃথক করা যায় ।
(২) সিদ্ধ করা ধান ভাঙালে খুদের পরিমাণ কম হয় ।
(৩) সিদ্ধ চালের পুষ্টি উপাদান বেশি হয়।
(৪) সিদ্ধ চালের পোকমাকড় প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
(৫) সিদ্ধ চালের কুঁড়ায় তেলের (Rice bran oil) পরিমাণ বেশি হয়।
(৬) সিদ্ধ চালের মাড়ে আতপ চালের মাড় অপেক্ষা কম খাদ্যমান অপচয় হয়।
অসুবিধা :
(১) সিদ্ধ করার ফলে চালের প্রাকৃতিক জারণ প্রতিরোধক বা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তা গুদামজাত অবস্থায় তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়।
(২) সিদ্ধ চাল রান্না করতে বেশি সময় লাগে এবং বেশি জ্বালানি খরচের প্রয়োজন হয়।
(৩) সিদ্ধ ধান বেশি দিন সংরক্ষণ করলে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়।
ধান সিদ্ধকরণ পদ্ধতি :
কৃষকের বাড়িতে হাঁড়ি, পাতিল, ডেগচি, কড়াই বা তাফালে ধান সিদ্ধ করা হয়। ভিজিয়ে রাখা ধান পাত্র থেকে তুলে রাখা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী পানি দিতে হয়। পাত্র চুলার উপর রেখে জ্বাল দিতে থাকলে যখন বেশির ভাগ ধান ফেটে যায় তখন উঠিয়ে এনে উঠানে বা চাতালে মেলে রোদে শুকানো হয়। ধান সিদ্ধ করার পদ্ধতি দুই-প্রকার। যথা (১) প্রচলিত পদ্ধতি ও (২) আধুনিক পদ্ধতি।
প্রচলিত পদ্ধতি : আমাদের দেশের প্রয়োজনীয় সিদ্ধ ধানের প্রায় সমস্তটাই প্রচলিত বা দেশীয় পদ্ধতিতে সিদ্ধ করা হয়। এ পদ্ধতি আবার দুই প্রকারের। যথা-
ক) একসিদ্ধ পদ্ধতি : বিভিন্ন পাত্রে ধান ১-৩ দিন পর্যন্ত ভিজানো হয়। তারপর জ্বাল দিয়ে সিদ্ধ করে শুকানো হয়।
খ) দুইসিদ্ধ পদ্ধতি : ধান পানিতে ডুবানোর পূর্বে আংশিক পানিপূর্ণ পাত্রে রেখে তাপ প্রয়োগ করা হয়। তাপের ফলে উৎপন্ন জলীয় বাষ্প ধানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা হয়। এ অবস্থায় গরম ধানকে স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হয়। প্রায় ১ দিন পর্যন্ত ডুবিয়ে রাখার পর ভিজা ধানকে উপরে বর্ণিত একসিদ্ধ পদ্ধতিতে সিদ্ধ করা হয়। দুই সিদ্ধের চাল বেশ শক্ত হয়। উভয় পদ্ধতিতেই ধান সিদ্ধ করার সময় যখন ধানের খোসা ফেটে দুই ভাগ হয়ে যায় তখন ধান সিদ্ধ সম্পন্ন হয়।
আধুনিক পদ্ধতি : আধুনিক পদ্ধতি তিন ধরনের। যথা-
ক) ধান ভিজিয়ে সিদ্ধ করার ধীর পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে পাকা চাতালের বা প্লাটফর্মের (plat from) উপর চোঙ্গাকৃতি এক বা একাধিক ইট বা সিমেন্টের (tank) বা কেটেল এ ধান ভিজানোর হয়। ২৪-৭২ ঘণ্টা ভিজানো ধান এখানে স্থানান্তর করা হয়। এই (tank) বা কেটেল একটি নল দ্বারা বয়লারের সাথে সংযুক্ত থাকে। নলটি ট্যাঙ্কের মাঝামাঝি স্থান দিয়ে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢুকানো থাকে। বয়লার থেকে পানির বাষ্প সমস্ত ট্যাঙ্কের ধানে ছড়িয়ে পড়ে। বাষ্প নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নলে ভাল্ভ (Valve) লাগানো থাকে। বয়লারের পানি চুলার আগুনে বাষ্পে পরিণত হয়। বাষ্পের তাপে যখন সমস্ত ধান সিদ্ধ হয়ে খোসা ফেটে যায় তখন ট্যাঙ্ক বা কেটেলের নিচের ভালব খুলে সিদ্ধ ধান বের করে আনা হয়। অতঃপর তা শুকানো হয়।
(খ) ভারতীয় পদ্ধতি : এ পদ্ধতি ভারতের কেন্দ্রীয় খাদ্য কারিপরি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (CFTRI) কর্তৃক উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে স্টিলের তৈরি সিদ্ধকরণ ট্যাঙ্ক বা কেটেল ব্যবহার করা হয়। বয়লার থেকে বাম্প ট্যাঙ্কে প্রবেশ করার উপযোগী করে নলগুলো বিন্যস্ত থাকে। ট্যাকের উপরের অংশে পানি প্রবেশের নল থাকে। ট্যাঙ্কের নিচে দুইটি তাতে থাকে, একটি দিয়ে ট্যাঙ্কের পানি নিষ্কাশন করা হয় এবং অন্যটি দিয়ে সিদ্ধ ধান বের করা হয়। ট্যাঙ্কে পানি প্রবেশ করানোর পর বয়লার থেকে বাষ্প প্রবেশ করানো হয়। বাষ্পের তাপে পানির তাপমাত্রা যখন 85°C হয়ে যায় তখন ধানকে উক্ত গরম পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। স্বয়ংক্রিয় কনভেয়ারের সাহায্যে ধানকে সিদ্ধকরণ ট্যাঙ্কে ফেলা হয়। কিছুক্ষণ পর ধান ও পানি মিত্রণের তাপমাত্রা 70°C এ এসে যায় । এই তাপমাত্রা যেন স্থির থাকে সেজন্য ট্যাঙ্কের ভিতর পানি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রবাহিত করা হয়। এ অবস্থায় ৩-৪ ঘন্টা থাকার পর নিচের ভাত দিয়ে গরম পানি সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর ধানের মধ্যে গরম বা প্রবাহিত করে ধানকে সিদ্ধ করা হয়। বাম্পের পানি বের হওয়ার জন্য নিচে ভাত খোলা রাখা হয়। অধিকাংশ ধানের খোসা ফেটে গেলে ধান সিদ্ধ সম্পন্ন হয়।
(গ) প্রেসার পদ্ধতি : এটি ভারতে উদ্ভাবিত আধুনিক পদ্ধতি। এতে খানকে 90°C গরম পানিতে ৪০ মিনিট ডুবিয়ে রাখা হয়। এরপর উক্ত ভেজা ধানে ১৮ মিনিট পরম বাষ্প প্রবাহিত করা হয়। এ পদ্ধতিতে উচ্চ চাপে ধানের মধ্যে বাষ্প প্রবাহিত করা হয়। এতে সিদ্ধ ধানের রং কিছুটা হলুদ হয় এবং ভালা চাল ও খুদের পরিমাণ কম হয়।
সিদ্ধ ধান শুকানো :
সাধারণ বা আতপ ধান শুকানোর মতো সিদ্ধ করা ধান শুকানো যায় না। সিদ্ধ ধান খুব ধীরে শুকালে ক্ষতিকর অনুজীবের আক্রমণে ধান নষ্ট থেকে পারে। পক্ষান্তরে দ্রুত শুকালে চালে ফাটল তৈরি হয় এবং মিলিং-এর সময় ভাঙ্গা চালের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। শুধু তাই নয় ধান সকল দিকে সমভাবে কানো উচিত। সুতরাং সিদ্ধ খান দুই পর্যায়ে শুকাতে হয়। প্রথম পর্যায়ে জলীয় অংশ ১৬% পৌছানোর আগেই শুকানো বন্ধ করে ছারার জমা করে কয়েক ঘন্টা রাখতে হবে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে শুকিয়ে জলীয় অংশ ১৪% বা তার কম করতে হবে । এভাবে শুকানোর মাঝে বিরতি দেওয়াকে টেম্পারিং বলে। রোদে ওকানোর ক্ষেত্রে এক রোদে না শুকিয়ে ২- ৩ দিনের রোদে শুকানো উচিত। প্রথমবার শুকানোর পর রাতের বেলা স্তূপীকৃত করে রাখলে টেম্পারিং-এর কাজ সহজেই হয়ে যায়। শুধু তাই নয় উঠানে ধান ছড়িয়ে দিয়ে ১ ইঞ্চি বা ২.৫ সে.মি. এর বেশি পুরু না করে ঘন ঘন উল্টারে দেওরা উচিত। বিভিন্ন ধরনের ড্রায়ারের মধ্যে অবিরাম প্রবাহলীল ও টেম্পারিং ব্যবস্থাযুক্ত প্রায়ার দ্বারা ধান শুকানো উচিত।
ধান থেকে তুষ ও কুঁড়া সরিয়ে ফেলার প্রক্রিয়াকেই মিলিং বা ধান ভাঙানো বলে। ধান মিলিং দুই ভাবে করা যায়। যথা- (ক) প্রচলিত মিলিং (খ) আধুনিক মিলিং
প্রচলিত সিলিং : প্রচলিত মিলিং বা ধান ভাঙানোতে যে সকল যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয় তা হল (১) গাইল ও সিয়া (২) ঢেঁকি।
আধুনিক মিলিং-এর যন্ত্রপাতিগুলো নিম্নরূপ-
(১) তুষ ছাড়ানো মেশিন (Husker)
(২) মিলিং মেশিন : এটি ভূম ছাড়ানো, কুঁড়া ছাড়ানো ও চাল চকচকেকরণ একত্রে সম্পন্ন করে।
(৩) রাইস মিলিং প্লান্ট : এ প্লান্টে ধান ঝাড়াইকরণ, সিদ্ধকরণ, শুকানো, তুষ ছাড়ানো, কুঁড়া ছাড়ানো, চাল থেকে খুদ ও কুঁড়া পৃথকীকরণ, আকার অনুযায়ী বাছাইকরণ ইত্যাদি সুবিধা সম্বলিত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ধান একসাথে প্রক্রিয়াজাত করা যায়।
তুষ ছাড়ানো মেশিন : এটি দুই ধরনের যথা (ক) মন পদ্ধতি যেমন- ধানকল বা হলার (খ) রোলার পদ্ধতি যেমন- রাবার রোলার হাঙ্কার
রাইস হুলার বা ধান কল : আমাদের দেশে বর্তমানে বহুল প্রচলিত ছোট ছোট ধানকলগুলোতে ঘর্ষণ বা ফ্রিকশান পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ধান ভাঙানো হয়। এতে ভূষ খসানোর সাথে সাথে কুঁড়া ছাড়ানো ও সামান্য পোলিশিং-এর কাজ একই সাথে সম্পন্ন হয়। এসব রাইস হলারগুলো আমাদের দেশে ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। স্থানীয় ভাষায় এদেরকে ধান কল বলে। এগুলোর দাম কম, স্থাপনে জায়গা কম লাগে, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খুব সহজ এবং দেশেই তৈরি করা যায়। এগুলোর অসুবিধা হলো ভাঙা চাল ও খুদের পরিমাণ বেশি হয়। তাছাড়া চালের সাথে তুষ, কুঁড়া, খুদ ও ভাঙ্গা চাল একত্রে মিশে যায়।
হাঙ্কার : এই যন্ত্রে একই ব্যাসের দুইটি রাবার রোলার পাশাপাশি সেট করা হয়। রোলার দুইটির একটি বেশি গতিতে অন্যটি ধীর গতিতে ঘুরে। হলার থেকে ধান নিয়ন্ত্রিতভাবে রোলার দুইটির মাঝে পড়ে। মেশিন চালু করলে রোলার দুইটি তিগতি এবং বিপরীত গতিতে ঘুরতে থাকে। ফলে ধানের খোসা বিভক্ত হয়ে চাল বেরিয়ে আসে। এভাবে ধান মিলিং করার সুবিধা হলো এতে খুদের পরিমাণ কম হয় এবং চালের ভ্রূণ বা এপিডার্মিস অক্ষত থাকে। এপিডার্মিসের আবরণ গুদামজাত অবস্থার চালকে নষ্ট হতে দেয় না। এ প্রকার হাক্ষারের দাম বেশি, গঠন জটিল এবং বর্তমানে আমাদের দেশের তৈরি হয় না।
কুঁড়া ছাড়ানো যন্ত্র : ধানের খোসা ছাড়ানোর পর যে চাল পাওয়া যায় তার উপর লালচে বর্ণের কুঁড়ার আবরণ থাকে। এটি পরিপাক ক্রিয়ায় অসুবিধা সৃষ্টি করে। এজন্য চালকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য করার জন্য কুঁড়া ছাড়ানো যন্ত্রের সাহায্যে তা তুলে ফেলতে হয়। এ যন্ত্রটিতে দুইটি প্রধান অংশ থাকে তা হলো ছিদ্রযুক্ত ধাতব সিলিন্ডার অ্যাবাসিত রোলার। এর মাঝে থাকে ফাঁকা স্থান। এই ফাকা স্থানেই ঘৰ্ষণ পদ্ধতিতে মোটর দ্বারা রোলার ঘুরানোর ফলে চালের কুঁড়া আপসারিত হয়ে নিয়ে গঠিত হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট (ব্রি) পাওয়ার উইনোয়ার (শক্তি চালিত কুঁড়া ছাড়ানো যন্ত্র) উদ্ভাবন করেছে যা ০.৫ অন্বশক্তিসম্পন্ন। স্থানীয়ভাবে এটি তৈরি করা যায়। এটি দুই জন শ্রমিক চালিয়ে প্রতি কর্মদিনে ৮০০-১০০০ কেজি চাল পরিষ্কার করতে পারে।
মিলিং মেশিন : ধান থেকে খাদ্য উপযোগী চাল পেতে হলে ধানের খোসা ছাড়ানো, কুঁড়া ছাড়ানো, ঝাড়াই করা, সাদা করা, তুষ ও কুঁড়া আলাদা করা, ভাগ্নে চাল ও ফুল আলাদা করা ইত্যাদি প্ররিালো সম্পন্ন করতে হয়। এ সকল প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করার জন্য হাস্কার, হোয়াইটেনিং মেশিন ও পলিশিং মেশিন ইত্যাদি একত্রে সমন্বিত করে কম জায়গায় ও কম শ্রমিকের যারা সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাকে মিশিং প্রক্রিয়া এবং ব্যবহৃত যন্ত্রাবলিকে একত্রে মিলিং মেশিন বলে। উন্নত দেশের বেশির ভাগ খামারে মিলিং মেশিন দ্বারা। ধান প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণ করা হয়। মিলিং মেশিনের বিভিন্ন অংশের নাম নিম্নে দেওয়া হলো-
(১) ধান পরিষ্কারক
(২) ধানের খোসা ছাড়ানো যন্ত্র
(৩) ধান আলাদাকারক
(৪) এলিভেটর
(৫) কুঁড়া ছাড়ানো যন্ত্র
(৬) কুঁড়া টানার ফ্যান
(৭) সাইক্লোন
(৮) চালনী
(৯) গ্রেডার ইত্যাদি।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. পৃথিবীতে দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য শস্যের না কী?
২. বাংলাদেশে বছরে হেক্টর প্রতি কত ধান এবং চাল উৎপাদন হচ্ছে?
৩. ধান এর সংজ্ঞা লিখ ।
৪. ধান কী জাতীয় ফল?
৫. চালের সংজ্ঞা দাও ।
৬. ধানের কয়টি উপজাত ও কী কী?
৭. বাংলাদেশে উৎপাদিত ধানের উপজাতের নাম কী?
৮. আউশ ধান কখন বোনে ও কখন পাকে?
৯. কোনটি শীতকালীন ধান? এটি কখন বোনে ও কখন পাকে?
১০. ২০১৬ পর্যন্ত ব্ৰি কতগুলো ধানের জাত অবমুক্ত করেছে?
১১. ব্রি ধান-৪২ এবং ৪৩ এবং প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?
১২. ব্রি ধান-৫০ এর বৈশিষ্ট্য কী?
১৩. ব্রি ধান-৫৩ ও ৫৪ এর বৈশিষ্ট্য কী?
১৪. জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান কোনটি?
১৫. ধানের বহিরাবরণ ও চালের বহিররাবরণকে কী বলে?
১৬. চালের অ্যালুরেন স্তর কোনটি?
১৭. চালের মোট কত ভাগ শস্য বা Endosperm ?
১৮. 'চালের জৈবিক মান ৬৮' বাক্যটির অর্থ কী?
১৯. চালে ভিটামিন বি পরিবারের কয়টি ভিটামিন থাকে? এগুলো কীকী?
২০. বাংলাদেশের মানুষের ভাত-সবজি খাওয়ার অনুপাত কী?
২১. ধান সংরক্ষনের জন্য ধানে কতভাগ আর্দ্রতা থাকা প্রয়োজন?
২২. ধানের গুদামে সবচেয়ে ক্ষতিকারক পোকা দুইটি কী কী?
২৩. সাইলো বলতে কী বুঝায়?
২৪. 'রাইস উইভিল' কী? কীভাবে ক্ষতি করে?
২৫. কেড়ি পোকাকে ইংরেজিতে কী বলে?
২৬. লাল শূসরী পোকা কীভাবে আক্রমণ করে?
২৭. খাপড়া বিটল কী?
২৮. রাইস মথ, রাইস মিল মথ, ইন্ডিয়ান মিল মথ এদের বাংলানাম কী?
২৯. গুদামে সংরক্ষণ কালে ধানের সাথে কী কী গাছের পাতার গুঁড়া মিশালে ভালো হয়?
৩০. গুদামজাত শস্যদানা রক্ষার জন্য কোন ঔষধ ব্যববহার করা উচিত?
৩১. সুগন্ধিচাল কেন সিদ্ধ করা হয় না?
৩২. সিদ্ধ করা চাল কেন তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়?
৩৩. ধান সিদ্ধ করার আধুনিক পদ্ধতি কয়টি ও কী কী?
৩৪. প্রেসার পদ্ধতিতে ধান সিদ্ধ করার জন্য কত তাপমাত্রায় কতক্ষণ ধান পানিতে রাখতে হয়?
৩৫. টেম্পারিং বলতে কী বুঝায়?
৩৬. মিলিং বলতে কী বুঝায়?
৩৭. ধান মিলিং মেশিনে কী কী অংশ থাকে?
৩৮. পাওয়ার উইনোয়ার বলতে কী বুঝায়?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. ধান ও চালের সংজ্ঞা দাও।
২. ধানের তিনটি উপজাতের বর্ণনা দাও।
৩. মৌসুম ভিত্তিক তিন প্রকার ধানের বর্ণনা দাও।
৪. ধান বীজের অংশ কয়টি ও কী কী চিত্র সহ বর্ণনা কর?
৫. চালের অ্যালুরেন স্তরের সুবিধা ও অসুবিধা কী?
৬. কলে ছাঁটা ও ঢেঁকি ছাঁটা চালের পুষ্টিমান বর্ণনা কর।
৭. ধান ও চালের ব্যাবহারের বিধি কী কী?
৮. গুদামে ধান কী কী কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার বর্ণনা দাও।
৯. ধানের প্রধান গোলাজাত পোকা মাকড়ের নাম লেখ।
১০. রাইস উইভিল ও গ্রেইন বিটলের বর্ণনা দাও।
১১. ধানে গুদামজাত পোকামাকড়ের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা লেখ।
১২. আতপ ও সিদ্ধ চাল বলতে কী বুঝায়?
১৩. ধান সিদ্ধকরণের সুবিধা কী কী?
১৪. সিদ্ধ ধান শুকানোর প্রক্রিয়া বর্ণনা কর।
১৫. আধুনিক মিলিং প্রক্রিয়ার ফ্লো চার্টটি লেখ।
১৬. আধুনিক মিলিং যন্ত্রপাতিগুলো কী কী?
১৭. মিলিং মেশিনের বিভিন্ন অংশগুলোর নাম লেখ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. ধান ও চালের বৈশিষ্ট্য, উল্লেখ করে এর উপজাত ও শ্রেণি বিভাগগুলো লিখ।
২. ধানের প্রধান প্রধান ১০টি জাতের বৈশিষ্ট্য লেখ।
৩. ধানবীজের বিভিন্ন অংশের বর্ণনা ও পুষ্টি লেখ।
৪. ধানের পুষ্টি ও পুষ্টির অপচয় বর্ণনা কর।
৫. ধান ও চালের ব্যবহার বিধি উল্লেখ কর।
৬. ধান সংরক্ষণকালীন ধানের ক্ষতির কারনগুলো বর্ণনা কর।
৭. বিভিন্ন প্রকার ধানবীজ গুদামঘরের বর্ণনা দাও।
৮. ধানের গোলজাত পোকামাকড়ের দমন ব্যবস্থার বর্ণনা দাও।
৯. শস্য গুদামজাত পোকামাকড় দমন ব্যবস্থার বর্ণনা দাও।
১০. ধান সিদ্ধকরণের আধুনিক পদ্ধতির বর্ণনা দাও।
১১. ধান সিদ্ধকরণের সুবিধা ও অসুবিধা ও ধান শুকানো বর্ণনা কর।
১২. রাইস হলার ও রাইস হাস্কারের বর্ণনা দাও।
১৩. মিলিং মেশিন কী? কুঁড়া ছাড়ানো যন্ত্র কীভাবে কাজ করে?